Header Ads

Header ADS

রেকর্ড খেলাপিতে ব্যাংক খাত নাজুক

                                     

রেকর্ড খেলাপিতে ব্যাংক খাত নাজুক



 বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন খেলাপি ঋণের কারণে অস্থির অবস্থার মুখোমুখি। বর্তমান সরকারের পদক্ষেপের পরে ঋণখেলাপির প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ।

বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়েও তা খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়নি। ২০২৫ সালের জুনে মোট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৪৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই লাখ ৪৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এটি বেড়েছে চার লাখ ৫৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা; যা ২০২৪ সালের জুনে ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা এটি উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন।

এই পরিস্থিতিতে, পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে মার্জার বা একীভূত করার কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণখেলাপির লাগামহীন কর্মকাণ্ড ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বাড়াচ্ছে এবং নতুন ঋণ বিতরণ কঠিন করছে। ফলে ব্যবসায়ীরা উচ্চ সুদের চাপের মুখে পড়ছেন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমছে এবং আমানতকারীদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের দ্রুত বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলো হলো:

  1. শেখ হাসিনার সময় বহু নামে-বেনামে ঋণ বিতরণ করা হলেও তা গোপন রাখা হয়েছিল।

  2. আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী খেলাপি ঘোষণার সময়সীমা ছয় মাস থেকে তিন মাসে নামানো হয়েছে।

  3. কৃষি ও এসএমই ঋণে পূর্বে প্রদত্ত বিশেষ ছাড় বাতিল করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক প্রভাবে অনেক ব্যবসায়ী বিপুল ঋণ নিয়েও তা যথাযথ ব্যবহার করেননি; কেউ কেউ তা বিদেশে পাচার করেছেন এবং বর্তমানে পলাতক। অন্যদিকে, যারা পূর্বে রাজনৈতিক চাপে ব্যবসা করতে পারেননি, তারা এখনও খেলাপি ঋণের জট থেকে মুক্ত হতে পারেননি। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘ট্রানজিশন পিরিয়ড’ হিসেবে দেখছেন এবং আশা করছেন, পরবর্তী কয়েক প্রান্তিকে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড সচল হলে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি ধীরে ধীরে কমবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণ দেশের জিডিপির উল্লেখযোগ্য অংশের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৪২.৮৩ শতাংশ। অন্যদিকে, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এটি ২০ শতাংশ, যা আগে ১৫.৬০ শতাংশ ছিল।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল অর্থ বের করেছেন, যার একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্টের পর অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে। সেই ঋণগুলো খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। পূর্বে কিছু গ্রাহক আদালতের বিশেষ সুবিধায় খেলাপি ঋণ দেখাত, এখন সেই সুযোগ নেই। আইএমএফের শর্তের কারণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমস্যার সমাধান ছাড়া বিকল্প নেই। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের নীতি সহায়তা জুন থেকে কার্যকর হবে, আশা করছি এর পর খেলাপি ঋণ কমবে।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের গবেষণা পরিচালক ড. শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, ‘ঋণখেলাপি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে জটিল সমস্যা। এতদিন এটি আড়াল করা হয়েছে। এখন সমস্যাগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে, যা সরকারের সাফল্যের দিক। পালিয়ে যাওয়া গ্রাহক এবং লুকানো খেলাপির কারণে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এখন সঠিক গ্রাহকদের সাহায্য এবং অন্যদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বড় ঋণ দিতে নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই নীতি থেকে সরে এসেছে। এছাড়া ইসলামী ধারার পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানাচ্ছে, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যেমন এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। নতুন ঋণ বিতরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, যা দেশের বেসরকারি খাত ও ব্যবসায়ীদের সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে নতুন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সরকারী রাজস্ব সবই প্রভাবিত হচ্ছে। অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট।

No comments

Powered by Blogger.