সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকে জমে থাকা ‘অলস’ অর্থের পাহাড়
দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপুল অঙ্কের অর্থ দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোতে জমা রয়েছে। এসব আমানত থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য হারে সুদ আয় করছে এবং বছরে শেষে বড় অঙ্কের মুনাফা দেখাচ্ছে। কিন্তু সরকার নিজে অর্থ সংকটে থাকলেও এই ‘অলস’ আমানত সরাসরি কাজে লাগাতে পারছে না। বরং বিপরীতে সরকারকে ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে, যার কারণে সুদ পরিশোধের চাপ ক্রমেই বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। গত বছরের শেষে এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই আমানত বেড়েছে ২১ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। এতে ব্যাংকের আমানতের সুদও বেড়েছে। এই বাড়তি সুদের সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের আশায় ব্যাংকে টাকা জমা রাখছে।
এর স্পষ্ট উদাহরণ হলো পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটি ১৪৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে মুনাফা ছিল ৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মুনাফা বেড়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ বা ৬৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মুনাফা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো ব্যাংক আমানতের সুদ আয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে পদ্মা অয়েল ব্যাংকে রাখা অর্থ থেকে ১৭৭ কোটি টাকা সুদ আয় করেছে, যা গত বছর ছিল ১০০ কোটি টাকা। সুদ আয়ের বিপরীতে আলাদা কোনো ব্যয় না থাকায় এই আয় সরাসরি মুনাফায় যুক্ত হয়েছে।
তবে সব প্রতিষ্ঠানই সমানভাবে অর্থ ফেরত পাচ্ছে না। পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে জলবায়ু ট্রাস্ট পদ্মা ব্যাংকে ৮৭৩ কোটি টাকা রেখেছিল, যা এখনও তুলতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে সরকারি খাতের মেয়াদি আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কার্যালয়, মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আমানত মিলে ‘সরকারি খাতের মেয়াদি আমানত’ হয়েছে ৫৫ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। অপরদিকে, রাষ্ট্রীয় করপোরেশন, কর্তৃপক্ষ, বীমা প্রতিষ্ঠান, পেনশন ফান্ড ও আর্থিক মধ্যস্থতাকারীদের আমানত মিলে ‘অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান’ খাতে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১৩২ কোটি টাকা।
এই আমানতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৯৯ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, রাখা হয়েছে এক বছর থেকে দুই বছরের কম মেয়াদের জন্য। ছয় মাসের কম মেয়াদে রাখা হয়েছে ৪৩ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, ছয় মাস থেকে এক বছরের কম মেয়াদে ৩১ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা, দুই থেকে তিন বছরের কম মেয়াদে ১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা এবং তিন বছরের বেশি মেয়াদে ৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংকগুলোতে বিশেষ নোটিস আমানত (এসএনডি) হিসেবেও রাখা আছে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি খাতের অংশ ২২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা এবং বাকি ৮১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিট ৭২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। তবে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (আগস্ট পর্যন্ত) ঋণ কিছুটা কমে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে। তবুও এ অর্থবছরের জন্য সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, সরকার যদি সরাসরি এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ নিয়ন্ত্রণে নেয়, তাহলে তাদের কার্যক্রমে জটিলতা বাড়তে পারে। বরং প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, সেদিকেই সরকারের নজর দেওয়া উচিত।

No comments